ফয়সাল আজম অপু, বিশেষ প্রতিনিধিঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার শাহজাহানপুর ও সুন্দরপুর ইউনিয়নে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে ইটভাটায় এখনো নিষিদ্ধ ড্রাম চিমনি রয়ে গেছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অমান্য করে কয়লার বদলে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। আবার সেই কাঠ চেরাই করতে ইটভাটা এলাকায় বসানো হয়েছে নিষিদ্ধ করাতকল।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ অনুযায়ী ড্রাম চিমনির পরিবর্তে জিগজ্যাগ ও উন্নত প্রযুক্তির চিমনি ব্যবহার করে ইটভাটা চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চাঁপাইনবাবগঞ্জে ওই নির্দেশ উপেক্ষা করে ড্রাম চিমনি ব্যবহার করছেন ভাটার মালিকেরা। পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছ থেকে অনুমতি না নিয়েই চালানো হচ্ছে এসব ভাটা।
উপজেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সদর উপজেলায় ২৮ টি ইটভাটা আছে।
এর মধ্যে পরিবেশবান্ধব ও আইনসিদ্ধ চিমনি ব্যবহার করছে মাত্র চারটি ভাটা। অধিকাংশ ভাটাতেই পরিবেশবান্ধব চিমনি নেই। আইনের তোয়াক্কা না করে আবার দুটি ভাটায় ড্রাম চিমনি ব্যবহার করে ইট পোড়ানো হচ্ছে। তবে উপজেলা প্রশাসনের কাছে এ রকম ভাটার কোনো তথ্য নেই বলে জানান সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. রওশন আলী।
এই প্রতিবেদক সম্প্রতি সরেজমিনে দু’টি ইটভাটার সন্ধান পেয়েছেন, যেখানে অবৈধভাবে ড্রাম চিমনি ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব ভাটাসহ উপজেলার বেশির ভাগ ভাটায় কয়লার পরিবর্তে জ্বালানি কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হয়। উপজেলার শাহজাহানপুর ইউনিয়নে বিলের মধ্যে শফিক আলী ও রবিউলের মালিকানাধীন ভাটায় করাতকল স্থাপন করে কাঠ চেরাই করছেন। শ্রমিকেরা ওই কাঠ নিয়ে দিচ্ছেন ভাটায়। প্রতিটি ভাটায় হাজার হাজার মণ কাঠের স্তূপ দেখা গেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ সালের ১ জুলাই কার্যকর করা হয়েছে। ওই আইন অনুযায়ী, ড্রাম চিমনির সব অবৈধ ইটভাটা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র এবং জেলা প্রশাসনের সনদ দেওয়ার সুযোগ নেই। এ ছাড়া ইটভাটায় কয়লার পরিবর্তে জ্বালানি হিসেবে কাঠ পোড়ানোর ওপরও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আইন অমান্য করে যারা অবৈধ ভাটা নির্মাণ এবং কাঠ পোড়াবেন তাঁদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত-২০১০) অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইন কার্যকর করতে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে গণবিজ্ঞপ্তিও জারি করা হয়।
ভাটা সংলগ্ন আরাজী-সুন্দরপুর গ্রামের এক ভুক্তভোগী বাগান মালিক, প্রতিবন্ধী শফিকুল ইসলাম জানান, এই মাটি ও কয়টা আমগাছ আমার শেষ সম্বল। কিন্তু এই ভাটার মালিক জামাত-শিবির চেয়ারম্যান সাহিন জমিটা নেয়ার জন্য পায়তারা শুরু করেছে। ভাটার ব্যাপারে প্রতিবাদ করতে গেলেই আমাকে বিভিন্ন ভাবে হুমকি ধামকি দেখাচ্ছে। ড্রাম চিমনির ভাটার কালো ধোঁয়াতে এবছর আমগাছ গুলো মারা যাওয়ার আশংকা রয়েছে। এই বাগানের গাছ মারা গেলে কি করে খাবো? আমাকে সংসার নিয়ে পথে বসতে হবে।
সুন্দরপুর ইউনিয়নের ওই ড্রাম চিমনি ভাটার মালিক কথিত চেয়ারম্যান শাহিন আলী মুঠোফোনে বলেন, বাঙলা চুলায় (ড্রাম চিমনি) ইটভাটার অনুমতি দেওয়া হবে না তাই অনুমতি বা ছাড়পত্র চাওয়া হয়নি। তা ছাড়া নদী ভাঙনের কারণে ভাটা স্থায়ীভাবে করা হয় না বলেও অনুমতি নেওয়া হয় না। আপনার আরও ৩টি ভাটা আছে এবং অবৈধ ভাবে চালাচ্ছেন কিভাবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে দম্ভের সাথে তিনি বলেন, প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ভাটা চালাচ্ছি। তাই সাংবাদিক নিউজ করে আমার ভাটার কিছু করতে পারবেনা।
অপরদিকে, শাহজাহানপুর ইউনিয়নের আরেক ড্রাম চিমনি ভাটা মালিক শফিক জানান, কয়েক বছরে আমি হাওয়া ভাটায় খুব ক্ষতিগ্রস্থ তাই এবছর ড্রামচিমনি ভাটা করে পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। তাছাড়া এবছর কয়লা পাওয়া যাচ্ছে না তাই কাঠ পোড়াতে হচ্ছে। জেলা প্রশাসন বা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি। তবে ছাড়পত্রের জন্য শিগগিরই আবেদন করব।
বিশ্বব্যাপি মানবাধিকার ও পরিবেশ উন্নয়ন সংস্থা চাঁপাইনবাবগঞ্জ শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে অধিকাংশ ইটভাটা অবৈধ। এসব ভাটায় কাঠ পোড়ানোর ফলে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। ভাটা মালিকদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে অনেকগুলো অভিযোগ করা হয়েছে। তার পরও এগুলো বন্ধ হচ্ছে না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, গত ডিসেম্বর মাসের ২১ তারিখ জেলা প্রশাসনের যৌথ অভিযানে অবৈধ ড্রাম চিমনি চালানোর দায়ে সুন্দরপুর ইউনিয়নে সাহিন চেয়ারম্যানকে ১ লাখ টাকা জরিমানা ও ড্রাম চিমনি ভেঙে ফেলা হয়। তবে আবারও ড্রাম চিমনি কার্যক্রম চালাচ্ছে আমাদের জানা নেই। খুব শীঘ্রই জেলা প্রশাসনের সাথে পরামর্শ করে সাহিন চেয়ারম্যানের ভাটাসহ প্রতিটি অবৈধ ভাটার পর্যায়ক্রমে অভিযান শুরু করা হবে। আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির ইটভাটা ছাড়া অন্যসব ভাটা অবৈধ। পরিবেশ আইন অনুযায়ী কোনোভাবেই ড্রাম চিমনির ভাটা করতে দেওয়া হবে না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রওশন আলী বলেন, ড্রাম চিমনির কোনো ভাটার লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। পরিবেশ অধিদপ্তরকে বলা হয়েছে। আমরা যেকোনো সময় যৌথ ভাবে অভিযান চালাবো।
চলবে–